সমুদ্র হল লবণাক্ত জলের পরস্পর সংযুক্ত জলরাশি যা পৃথিবীর উপরিতলের ৭০ শতাংশেরও বেশি অংশ আবৃত করে রেখেছে। সমুদ্র পৃথিবীর জলবায়ুকে সহনীয় করে রাখে এবং জলচক্র, কার্বন চক্র ও নাইট্রোজেন চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো স্থানে ফেলে দেওয়া একবার ব্যবহারযোগ্য প্লেট, গ্লাস, কাপ, স্ট্র, বেলুন স্টিক, প্লাস্টিক বোতল কিংবা প্লাস্টিক ব্যাগ তার গন্তব্য হিসেবে খুঁজে নিচ্ছে সমুদ্রকে। তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে সেই এলাকার জীবন আর প্রকৃতিকে। জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে, যা থেকে মানুষেরও বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। মারাত্মকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে সমুদ্রের তলদেশে থাকা জীব। অপচনশীল প্লাস্টিক বছরের পর বছর সমুদ্রে ভাসতে থাকে।সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র হলো পৃথিবীর জলজ বাস্তুতন্ত্রের বৃহত্তম। সামুদ্রিক প্রাণীর একটি বড় অংশ সাধারণত খাদ্যের জন্য সমুদ্রে ভাসমান ক্ষুদ্র প্রাণিকণা (জুপ্ল্যাঙ্কটন) এবং উদ্ভিদকণার (ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন) উপর নির্ভরশীল।তবে শুধু সমুদ্র নয়, যেকোনো জলাশয়ের জন্য এই ক্ষুদ্র প্রাণীদের ভূমিকা অপরিসীম।
সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্যশৃংখলে প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক আর অক্সিজেন সরবরাহকারী হিসেবে এই প্ল্যাঙ্কটনদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের একটা বড় অংশ যখন সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে, তখন তা বেশ ভয়ংকরভাবেই প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করছে।সমুদ্রের নীল জলরাশির উপর কালো ছায়ার মতো বিশাল ক্ষেত্রফলজুড়ে প্লাস্টিক ছড়িয়ে আছে। এই বিপর্যয় যে কতটা ভয়াবহ হয় উঠছে, তা উপকূলীয় এলাকায় বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়। আর বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই প্লাস্টিকের ফলে সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহের প্রথম ধাপটিই শিকার হয়েছে বাধার।
তবে সমুদ্রে জমে থাকা প্লাস্টিকের ফলে সৃষ্ট সমস্যার তালিকা এখানেই শেষ হচ্ছে না।৷৷ সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, সামুদ্রিক পাখিদের প্রায় নব্বই শতাংশ সরাসরি প্লাস্টিক দূষণের শিকার। ষাটের দশক থেকেই সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় পাখিদের উপর প্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে জরিপ চালানো হয়। ষাটের দশকে পরিমাণ ছিলো পাঁচ শতাংশেরও কম পাখির পাকস্থলীতে পাওয়া যেত প্লাস্টিক। আশি আর নব্বইয়ের দশকে শিল্প কারখানায় প্লাস্টিক উৎপাদন সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি কপাল পুড়েছে পাখিদেরও। কিছু গবেষণা বলছে, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সামুদ্রিক পাখির পাকস্থলীতেই পাওয়া যায় প্লাস্টিক।সামুদ্রিক শৈবাল থেকে সামুদ্রিক ঘাস বিবর্তিত হয়েছিল যা জমি উপনিবেশে স্থাপিত হয়ে স্থল উদ্ভিদে পরিণত হয় এবং তার প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর পর এগুলো আবার সমুদ্রে ফিরে আসে। মানব কার্যকলাপের কারণে যদিও এখন সামুদ্রিক ঘাসের মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ভূমি থেকে দূষণ, মাছ ধরার নৌকা যা ঘাস উপড়ে ফেলেছে এবং বর্তমানে অতিরিক্ত মাছ ধরা হচ্ছে যা বাস্তুতন্ত্রের জন্য ভারসাম্যহীন। প্রতি ঘন্টায় এখন প্রায় দুটি ফুটবল মাঠের সমান সামুদ্রিক ঘাস ধ্বংস করা হচ্ছে।শুধুই কি জলে আর স্থলে? প্লাস্টিকের বিচরণ আজ সর্বত্র। শুধুমাত্র সাগরের উপরিভাগ নয়, প্লাস্টিক দূষণ পৌঁছে গেছে সাগরের গভীর তলদেশেও। জানা গেছে, মানুষের আবিষ্কৃত পৃথিবীর গভীরতম সামুদ্রিক খাত মারিয়ানা ট্রেঞ্চেও মিলেছে প্লাস্টিকের উপস্থিতি।
১৯০৭ সালের ১১ জুলাই, বেলজিয়ামের রসায়নবিদ লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ডের হাত ধরে পৃথিবীতে প্লাস্টিকের আগমন ঘটে। প্লাস্টিক বর্জ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সিগারেটের বাট থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের বোতল, বোতলের ক্যাপ থেকে শুরু করে খাবারের মোড়ক, পলিথিন ব্যাগ থেকে শুরু করে পলিইস্টাইরিনের পাত্র ইত্যাদি। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এর (ESDO) গবেষণা অনুযায়ী, বছরে শুধুমাত্র এধরনের প্লাস্টিকের বর্জ্য জমা হচ্ছে প্রায় ৮৭,০০০ টন। জাতিসংঘের ২০১৫ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি বছর সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে অন্তত ৮০,০০,০০০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক; যার ৬৭ ভাগ বর্জ্য পদার্থই নদীর মাধ্যমে এশিয়ার দেশগুলো থেকে সাগরে যাচ্ছে। সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবহন করা শীর্ষ নদীগুলোর মধ্যে ২০টি নদীই এশিয়ার।সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের তালিকায় শীর্ষ স্থান লাভ করা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থানে রয়েছে এশিয়ার দেশ চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের এর নাম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ রয়েছে দশম স্থানে।
কাঠামোগত জীববিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে জন ম্যাকগিহ্যান এনজাইম সম্পর্কে কী না জানেন! তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃতিতে, আবর্জনার স্তূপসহ সব রকম নোংরা জায়গায় আমরা ব্যাকটিরিয়ার খোঁজ করছি৷ সেই ব্যাকটিরিয়া প্লাস্টিক খেয়ে হজম করে নিচ্ছে৷''
প্লাস্টিক খায়, এমন জীবের সন্ধান করাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য৷ এমন জীবের এনজাইম আলাদা করে বায়ো-রিয়্যাক্টরে বড় আকারে উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ অবশ্যই গোটা বিশ্বের সমুদ্রের উপর এনজাইম ছড়ানো সম্ভব নয়৷ যে প্রাস্টিক বর্জ্য প্রকৃতি দূষণ করে চলেছে, সেটি দূর করতে এই প্রযুক্তি কাজে লাগবে না৷ কিন্তু এর মাধ্যমে আমাদের রিসাইক্লিং ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিপ্লব আনা যেতে পারে৷কোনোকিছু ঠিকমতো পুনর্ব্যবহার করতে চাইলে সেটির মৌলিক উপাদান বিচ্ছিন্ন করতে হবে, যাতে সেই উপাদান দিয়ে আবার নতুন করে কিছু তৈরি করা যায়৷ কিন্তু আমরা এখনো প্লাস্টিকের সংযোগ ভাঙতে পারি না বলে বড়জোর এক বা দুইবার রিসাইক্লিং করতে পারি৷ তারপর সেটি পুরোপুরি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে৷সে কারণে এই কীট ‘গেম চেঞ্জার', অর্থাৎ গোটা সমস্যার অভিনব সমাধানসূত্র হয়ে উঠতে পারে৷ প্রো. ম্যাকগিহ্যান বলেন, ‘‘বায়ো রিসাইক্সিং-এর মাধ্যমে প্লাস্টিক বিচ্ছিন্ন করে উপাদানগুলি অনন্তকাল ধরে ব্যবহার করা যেতে পারে৷
জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানী ছাড়াই বার বার সেগুলি কাজে লাগানো যেতে পারে৷''শুনতে কল্পবিজ্ঞান মনে হলেও ইতোমধ্যেই সেই কাজ শুরু হয়েছে৷ যেমন ফ্রান্সের ‘কারবিয়োস' কোম্পানি এনজাইম ব্যবহার করে প্লাস্টিকের বোতল রিসাইক্লিং করছে৷ শুধু এক বা দুই বার নয়, অনন্তকাল ধরে সেই কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব৷
writer
- Tamanna Tasnim
Comments
Post a Comment